নিশ্চয়ই সকল আমাল (এর প্রতিদান) নির্ভর করে নিয়াতের উপর, প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য তাই রয়েছে, যা সে নিয়াত করে। (১:১ বুখারিঃ তাওহীদ পাবলিকেশন)

আমার স্ত্রী সবসময় রেগে থাকে



অনুবাদক: মোছ্‌তানছের বিল্লাহ্‌ | সম্পাদনা ও প্রকাশনায়: কুরানের আলো ওয়েবসাইট

প্রশ্নঃ

আমরা এক নবদম্পতি আর আমার ধারনা আমার স্ত্রী সবসময় রেগে থাকে। যখন আমরা বিয়ের জন্য পরিকল্পনা করেছিলাম, তখন তার মেজাজ মর্জি আমার মনে হতো তার বিবাহ পূর্ববর্তী অজানা আশংকার অথবা দুঃশ্চিন্তার বহিঃপ্রকাশ। যাইহোক তার সেই অবস্থা বিবাহের পরেও বিদ্যমান এবং নতুন মাত্রায় রাগের প্রকাশ আরম্ভ হলো। আমি যতই ক্ষুদ্র কাজ করি বা সামান্যই বলি, যেটা আমার দৃষ্টিতে খুবই যুক্তিপূর্ণ ও নির্দোষ, সেটা তাকে রাগম্বিত করে তুলে, ফলশ্রুতিতে সে আমার সাথে কথা বলা থেকে বিরত থাকে। উদাহরনস্বরূপ, ধরুন সে আমাকে ফোনে কল করলো, আমি কাজে ব্যস্ত আছি আর ফোন রিসিভ্‌ করতে ক্ষানিক দেরি হল, সে রেগে যায়। যদি আমি তার সাথে যথেষ্ট সময় অতিবাহিত করতে না পারি, তাহলেও সে রেগে যায়। খাবার শেষে আমি যদি সাথে সাথে থালা-বাসন ধুয়ে না রাখি, তাহলেও রেগে যায়। আমি তাকে বুঝানোর চেষ্টা করেছি যে আমি তাকে উপেক্ষা করিনা বা তাকে হেয় করিনা অথবা তার প্রতি আমার কোন হতাশাও নেই, কিন্তু ফলাফল শুন্য। এবং সে এটাও স্বীকার করে না যে, সে যখন এমন রাগান্বিত আচরণ করছে, আমিও তার মত রেগে যাচ্ছি না। আমি আমার পরিবার ও বন্ধুমহলেও এ ব্যাপারে আলোচনা করেছি পরামর্শের জন্য। প্রত্যেকেই আমাকে পরামর্শ দিলো আমি যেন সেই রাগের সময় গুলোতে তাকে রাগ কমে যাওয়ার সময় ও সুযোগ দেই। আমি আমার স্ত্রীকে অনেক ভালবাসি এবং তাকে আমি সুখি দেখতে চাই; কিন্তু আমি বুঝে পাচ্ছিনা কিভাবে আমাদের সম্পর্কের উন্নতি ঘটাবো। আমাকে পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করুন।

উত্তরঃ

আপনাদের দু’জনেরই পরস্পরের সাথে ভাবগত ভাষা প্রকাশের যথেষ্ট অভাব আছে অন্যকথায় মানসিক যোগাযোগ প্রাপ্তি হয়ে উঠেনি। যেকোন রকমের রাগের বহিঃপ্রকাশ বৈবাহিক জীবনে অত্যন্ত ক্ষতিকর। এরকম প্রতিটি রাগের বহিঃপ্রকাশ পরস্পরের মধ্যকার আবেগ গুলিকে এক এক করে ধ্বংস করে, যার ফলে এক পর্যায়ে দূরত্ব, একাকীত্ব, অপমানবোধ ও হতাশা  বৃদ্ধি পায়। হতে পারে আপনার স্ত্রী মানসিকভাবে আপনাকে আরো কাছে পেতে চায়, আর তা না পেলে সে নিজেকে আপনার তরফ থেকে ‘প্রত্যাখ্যাত’ মনে করে। এই প্রত্যাখ্যাত হওয়ার অনুভূতিটাকেই সে রাগের মাধ্যমে বহিঃপ্রকাশ ঘটায়।  অর্থাৎ সে যখন তার অনুভূতি প্রকাশ করতে বার বার ব্যার্থ হয় তখন সে আপনা থেকেই রেগে যায়, হতে পারে নিজের উপরই রেগে থাকে কিন্তু ক্ষোভ প্রকাশ পায় আপানার উপর। আর এই ধরনের ব্যাপারগুলি সদ্য বিবাহিত দম্পতিদের বেলায় খুব সাধারন যারা নিজেরা সঠিকভাবে পরস্পরের মানসিক, শারীরিক, পারিবারিক ও সামাজিক চাহিদাগুলো সম্পর্কে সাম্যকভাবে অবহিত নয়। প্রাকৃতিকভাবে একজন পুরুষ ভাবে শারিরীকভাবে কাছে যেতে পারাটাই হচ্ছে সম্পর্কন্নোয়নের সোপান আর একজন নারী ভাবে মানসিক নৈকট্য লাভের মাধ্যমেই সম্পর্কন্নোয়নের করতে। খুব সম্ভবত, আপনার স্ত্রী আপনার নিকট থেকে মানসিকভাবে নৈকট্য ও নিরাপত্তা লাভ করতে চাচ্ছেন। তার রেগে যাওয়ার ব্যাপারটি হচ্ছে একটা অপরিপক্ক পন্থা যার মাধ্যমে সে নিজের মানসিক চাহিদাকে ও হতাশাগুলোকে প্রকাশ করতে চাচ্ছে, কিন্তু পারছে না। পারস্পরিক সহযোগিতা ও আত্নোন্নয়নের মাধ্যমে এই প্রকাশ করার ক্ষমতাকে সাবলীল ও সৌন্দর্য্যমন্ডিত করতে হবে।

আপনার স্ত্রী যদি সারাক্ষন এমন রেগেই থাকে, তাহলে এমন পরিস্থিতি সবসময় বোঝা ও তা সামলানো আপনার জন্য কষ্টকর; আর এ থেকে আপনার মনে অসহায়ত্ব তৈরি হয় ও বৈবাহিক জীবনের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তার উদ্রেক করে। যখন সে রেগে যায় তখন আপনি হয়ত চান যে ঘোল পেকে যাওয়া ব্যাপারটা তাকে বুঝিয়ে বলবেন অথবা আপনি আত্নপক্ষ সমর্থনের জন্য নানা রকম বৈধ যুক্তির অবতারনা করবেন; কিন্তু এর কোন উপায়েই আসলে নৈকট্য ও আন্তরিকতা পাওয়া যায় না। বরং সে যখন রেগে যায়, সেই মুহূর্তগুলোকে তার সাথে নতুনভাবে যোগসূত্র তৈরি করার একটি সুযোগ হিসেবে দেখুন। সে যখন রেগে যায়, সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের কিছু করুন, তিনি কি বলতে চাচ্ছেন অথচ বলতে পারছেন না, তা সত্যি সত্যি মনোযোগ দিয়ে বোঝার চেষ্টা করুন।

উদাহরণস্বরূপ, আপনি সারাদিন কর্মব্যাস্ততার পরে বাসায় ফিরলেন, ক্লান্তি আর অবসাদ নিয়ে। আপনার স্ত্রী এই মুহুর্তে আপনাকে দেখাতে লাগলো যে, তিনি আপনার জন্য আপনার পছন্দের খাবারটি রান্না করেছেন। আপনি অনেক ক্লান্ত আর তাই নির্লিপ্তভাবে বল্লেন যে আপনি একটু ফ্রেশ হয়ে তারপর খাবার খেতে চলে আসবেন। আপনি অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই ভাল মন নিয়েই বল্লেন কিন্তু আপনার স্ত্রী রাগে ফেটে পড়লেন আর আপনি হলেন কিংকর্তব্যবিমূঢ়! এখন এখানে আপনি একটু বুদ্ধির ব্যবহার করুন, কিছুইনা আসলে আপনার লক্ষ্য হচ্ছে আপনার স্ত্রীর মনের কথাটা তার নিজের মুখ দিয়ে বের করে আনা। আপনি তার কাছে যান, তার হাত দুটো ধরেন, তার চোখে চোখ রাখুন আর নিচের কথোপকথোনের অবতারনা করুন।

স্বামী: “প্রিয়া, আমি তোমাকে ভালবাসি, তুমি কষ্ট করে আমার প্রিয় খাবার তৈরি করেছো, আমার অনেক ভালো লাগছে। আচ্ছা, তোমাকে কিছুটা হতাশ দেখাচ্ছে, কেন? তোমার কি হয়েছে আমাকে বল।” তিনি উত্তরে যাই বলুন না কেন, আপনি প্রস্তুত থাকুন ধৈর্য্য সহকারে শোনার জন্য। কারন তার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে তাকে বুঝতে পারাই আপনার জন্য চ্যালেঞ্জ। মনে রাখবেন আত্নপক্ষ সমর্থনে কোন কৈফিয়ত দেওয়া, কোন কিছুর ব্যাখ্যা বা তাকে কোণঠাসা করার জন্য আক্রমানাত্নক কথা বলা অথবা রাগতভাবে তাকে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার আর কোন দরকার নেই। এখন শুধু দরকার তার সাথে “আই কন্টাক্ট” বজায় রাখা বা চোখে চোখ রাখা এবং তিনি যা বলেন তার পিছনের প্রকৃত অনুভূতি উপলদ্ধি করা।

স্ত্রী: “তুমি আমার কোন কিছুতেই প্রশংসা করো না আমি তোমার জন্য যত ভালো কিছুই করিনা কেন। আমি চেষ্টা করি তোমার জন্য দারুন কিছু করার অথচ তুমি গুরুত্বই দাওনা।”

স্বামী: “ঠিক আছে, আমি দেখছি তুমি এ বিষয়ে নিয়ে হতাশ, এ ব্যাপারে তুমি আরো কিছু বল।”

স্ত্রী: “আমি রেগে যাই যখন আমি তোমার জন্য দারুন কিছু তৈরি করি আর তুমি তাতে প্রশংসা কর না। তখন আমার মনে হয় আমি আত কখনও তোমার জন্যে কিছুই রান্না করবো না।”

স্বামী: “হম্‌, আমি বুঝতে পারছি যে তুমি মনে করো যে তোমাকে উপযুক্ত প্রসংশা করা হচ্ছে না। তুমিও দিন শেষে ক্লান্ত হয়ে যাও আর চাও যে আমি যখন ঘরে ফিরি তখন কিছুটা সময় আমরা  একসাথে কাটাবো? এরকম কিছু কি?”

স্ত্রী: “হম, অনেকটা এরকমই।”


স্বামী: “প্রিয়তমা, এখন আমি বুঝতে পেরেছি। তোমার এসব কাজের জন্য তোমার প্রশংসা আমি মনে মনে করে থাকি কিন্তু আমি তা প্রকাশ করতে না পারার জন্য দুঃখিত। আর সারাদিন ধরে আমিও মনে মনে অপেক্ষায় থাকি যে কখন আমি তোমাকে দেখতে পাবো।”

স্ত্রী: “সত্যিই তুমি তাই ভাব? আমি আসলে সত্যি খুব দুঃখিত দ্রুত রেগে যাওয়ার জন্যে, আমি শুধু চাই, দিন শেষে একটা দারুন রাতের খাবার তৈরি করবো আর কিছুটা সময় কাটাবো তোমার সাথে, আর সারাদিনের দূরে থাকার অভাববোধটা কাটাবো।”

স্বামী: “তুমি যা অনুভব কর তা আমাকে বলার জন্য ধন্যবাদ। তোমার খোলামেলা কথার জন্য তোমার প্রসংশা করতে হয়। আচ্ছা আমি দ্রুত কাপড় বদলিয়ে, ফ্রেশ হয়ে খেতে আসি? আর খাবার টেবিলে বসে সারাদিন আমরা দু’জনে কে কি করেছি সেসব বিষয়ে কথা হবে কেমন?”

কিছু সাধারন উক্তির সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে আপনি একটি বৈবাহিক সম্পর্ককে পূর্ণতার দিকে বয়ে নিয়ে যেতে পারেন। কারন যখন আপনার স্ত্রী বুঝবেন যে আপনি তার অনুভূতিগুলো বুঝতে পারছেন বা বুঝার চেষ্টা করছেন তখন দেখবেন আপনা থেকে আপনার স্ত্রী আপনার মন মানসিকতার সাথে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে, আর এটাই স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক একটা রসায়ন। কেননা এভাবেই বৈবাহিক জীবনে পরস্পরের মানসিক যোগাযোগ স্থাপিত হয়ে থাকে। সম্পর্কের উন্নয়নের খাতিরে হলেও স্বামীর হিকমত ও ধৈর্যের সাথে সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করা উচিৎ। আল্লাহ বলেন: ভাল আর মন্দ কখনই সমান হতে পারে না; তুমি ভাল (কাজ) দ্বারা মন্দ (কাজ) প্রতিহত করো, তাহলেই (তুমি দেখতে পাবে) তোমার এবং যার সাথে তোমার শত্রুতা ছিল, তার মাঝে এমন (অবস্থা সৃষ্টি) হয়ে যাবে, যেন সে (তোমার) অন্তরঙ্গ বন্ধু।’ [সুরা হা-মীম-আস সাজদাঃ ৩৪]

আপনার স্ত্রী মানুষ হিসেবে মন্দ নন, কিন্তু তার অনুভুতির প্রকাশটি এক্ষেত্রে হয়তো ভাল মত হচ্ছে না। আপনার পরিণত প্রতিক্রিয়া তার অপরিনত রাগকে ইনশাল্লাহ ভালোর দিকেই পরিবর্তিত করবে।  রাগের পিঠে রেগে উত্তর দেওয়াই মানুষের স্বাভাবিক অভ্যাস। এই স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়াতে সবচেয়ে বেশী খুশী হয় শয়তান। ইবলিস তার বাহিনীর সেই শয়তানদের উপর সবচেয়ে বেশী খুশী হয়ে কাছে টেনে নেয় যারা স্বামী স্ত্রীর মাঝে বিচ্ছেদ ঘটাতে সক্ষম হয়। কাজেই অধৈর্য হয়ে নেতিবাচক কিছু করে ফেলে শয়তানের বিনোদনের খোরাক হয়ে জেন না যান সে বিষয়ে লক্ষ্য রাখবেন। কিছু ক্ষেত্রে ব্যাতিক্রম থাকতে পারে। কেননা, এই ধরনের সম্পর্কগুলোর উন্নয়ন মাঝে মাঝে কারো কারো ক্ষত্রে অনেক সময় জটিল হয়, আর একারনে প্রয়োজনে একজন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেয়া যেতে পারে। যিনি পরামর্শদাতা তিনি আপনাকে শিক্ষা দিতে পারবেন কি করে এসব ব্যাপারে পরস্পরের মাঝে ভাব বিনিময় করতে হয়। যদি একটি দম্পত্তি ক্রমাগত মানসিকভাবে অসুখী হতে থাকে, তাহলে তা এক পর্যায়ে নানামুখী সমস্যার জন্ম দিতে থাকে। এধরনের খারাপ অবস্থায় যাওয়ার পূর্বেই একজন দক্ষ পরামর্শকের পরামর্শের ভিত্তিতে (তিনি একজন মানসিক ডাক্তার হতে পারেন) স্বামী বা স্ত্রীর কাউকে হয়ত ঔষধ গ্রহণ করতে হতে পারে যেন কিছু ব্যাপারের নিয়ন্ত্রনে (যেমন হতাশা, ক্রোধ ইত্যাদি) ঔষধ সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে আর এর মাধ্যমে পুনরায় সম্পর্ক উন্নোয়নের আলো দেখানো যেতে পারে। সাংসারিক যেকোন মানসিক আঘাত ও রেগে যাওয়ার মত বিষয়গুলি ঠিক-ঠাক করে ফেলা সম্ভব, কিন্তু এর জন্য স্বামী বা স্ত্রী অথবা উভয়কেই ভাব বিনিময়ের কিছু প্রাকৃতিক কথোপকথনের ব্যাবহার ও আচরনের চর্চা করে নিতে হয় যাতে করে উভয়ের মাঝে সুষ্ঠভাবে মানসিক যোগাযোগ গড়ে উঠতে পারে। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, সবচেয়ে বড় নিরাময়কারী হচ্ছেন সর্বশক্তিমান আল্লাহ। তাই আল্লাহর কাছে দোয়া চাইতে হবে সবার আগে। কুরআনে এই জন্য আল্লাহ আমাদেরকে কে এই দোয়া শিখিয়েছেন-এবং যারা বলে: হে আমাদের পালনকর্তা, আমাদের স্ত্রীদের পক্ষ থেকে এবং আমাদের সন্তানের পক্ষ থেকে আমাদের জন্যে চোখের শীতলতা দান কর এবং আমাদেরকে মুত্তাকীদের জন্যে আদর্শস্বরূপ কর। [সূরা ফুরকানঃ ৭৪]

আল্লাহ প্রতিটি সংসারকে যেন হেফাজত করেন।

Related Posts

"আমার স্ত্রী সবসময় রেগে থাকে"

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সুন্দর স্বাবলম্বী ভাষায় কমেন্ট করার অনুরোধ রইলো.....

Iklan Atas Artikel

Middle Ad

Middle 2

Registered ad