মসজিদের সাথে সম্পর্ক
মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুর রহমান
মসজিদ আল্লাহ তাআলার ঘর এতে তাঁর যিকির ও ইবাদত হয়। তাঁর বড়ত্ব ও মহিমার বর্ণনা হয়। তাঁর তাওহীদ ও রুবুবিয়াতের আলোচনা হয়।
আল্লাহ তাআলা বলেন, (তরজমা) ... সেইসব গৃহে, যাকে মর্যাদা দিতে ও যাতে তাঁর নাম স্মরণ করতে আল্লাহ আদেশ করেছেন। তাতে সকাল ও সন্ধ্যায় তাঁর তাসবীহ করে সেইসব লোক, যাদেরকে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বেচাকেনা আল্লাহর স্মরণ থেকে এবং নামায কায়েম ও যাকাত আদায় থেকে গাফেল করে না...। Ñসূরা নূর (২৪) : ৩৬
অন্যত্র বলেন, (তরজমা) আল্লাহ যদি মানবজাতির এক দলকে অন্য দলের মাধ্যমে প্রতিহত না করতেন, তবে ধ্বংস করে দেওয়া হত (খ্রিস্টান সংসারবিরাগীদের) উপাসনাস্থান, গির্জা, (ইহুদীদের) উপাসনালয় ও মসজিদসমূহ, যাতে আল্লাহর যিকির করা হয় বেশি-বেশি...। সূরা হজ্ব (২২) : ৪০
এক বেদুইন মসজিদে পেশাব করলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, মসজিদে পেশাব বা কোনো ধরনের ময়লার কোনো অবকাশ নেই। এ তো কেবল আল্লাহর যিকির, নামায ও কুরআন তিলাওয়াতের জন্য। সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৮৫
পৃথিবীতে জায়গার কোনো শেষ নেই এবং সবখানে আল্লাহ তাআলার যিকির করা যায়। কিন্তু এসবের মধ্যে মসজিদ এক অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। এতে শুধু তাঁর যিকিরই করা যায়। যিকির পরিপন্থী কোনো কিছু তাতে জায়েয নয়। এগুলো মসজিদ নির্মাণের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য পরিপন্থী। হাদীসে এসেছে, যে ব্যক্তি মসজিদে কাউকে হারানো বস্তু সন্ধান করতে শোনে সে যেন বলে, আল্লাহ তোমার কাছে তা না ফেরান। কেননা মসজিদ এ কাজের জন্য বানানো হয়নি। সহীহ মুসলিম, হাদীস ৫৬৮
এজন্য মসজিদ আল্লাহ তাআলার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা এবং দিনরাত তাঁর রহমত নাযিলের ক্ষেত্র। হাদীসের ভাষায়Ñ ‘আল্লাহর কাছে সবচেয়ে পছন্দনীয় স্থান মসজিদ আর সবচেয়ে নিকৃষ্ট স্থান বাজার।’ সহীহ মুসলিম, হাদীস ৬৭১
এ থেকেই উপলব্ধি করা যায়, মসজিদের সাথে মুমিনের কী গভীর সম্পর্ক থাকা উচিত এবং সেটা তার জন্য কী উপকারী ও কল্যাণকর!
বস্তুত মসজিদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন আত্মিক প্রশান্তি লাভ, আল্লাহর নৈকট্য অর্জন ও ঈমান-আমল উন্নত করার এক পবিত্র ও বরকতময় উপায়।
সুতরাং মুমিনের কর্তব্য, মসজিদের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা এবং একে জ্ঞান ও আলো, হেদায়েত ও সফলতার কেন্দ্র মনে করা।
সম্পর্কের কিছু দিক
মসজিদের সাথে সম্পর্কের অনেক দিক আছে। এখানে গুরুত্বপূর্ণ কিছু দিক আলোচনা করা হল
১
এক. অন্তরগত সম্পর্ক
অন্তরগত সম্পর্কের বিভিন্ন দিক আছে। যেমন
(ক) মসজিদের স্বরূপ উপলব্ধি ও বিশ্বাস
আগে মসজিদের যে স্বরূপ উল্লেখ করা হয়েছে সেটি গভীরভাবে উপলব্ধি ও বিশ্বাস করা কর্তব্য। মসজিদের সাথে যাবতীয় সম্পর্ক নির্ভর করে এই উপলব্ধি ও বিশ্বাসের উপর। এটা যত গভীর ও আলোকিত হবে সম্পর্ক তত দৃঢ় ও সুন্দর হবে। তাই মসজিদের স্বরূপের যথার্থ উপলব্ধি ও বিশ্বাস অতি জরুরি।
আল্লাহর যিকিরের বিস্তৃত অর্থ ও নানা অধ্যায় এবং আল্লাহর যিকির পরিপন্থী বিষয়াদি সম্পর্কেও সঠিক জ্ঞান ও উপলব্ধি অর্জন করা প্রয়োজন। যাতে মসজিদের হক আদায় হয় আর না-হক কাজ থেকে মসজিদ পবিত্র থাকে।
(খ) মসজিদের সার্বিক কল্যাণ কামনা
মসজিদের সার্বিক কল্যাণ কামনার অর্থ, প্রতিটি গ্রামে মসজিদ প্রতিষ্ঠা হোক, এসব মসজিদ সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে পরিচালিত হোক, মুসল্লী ও যিকিরকারী দ্বারা পরিপূর্ণ হোক এবং এর মাধ্যমে সবখানে হেদায়েতের আলো ছড়িয়ে পড়ুক এ প্রত্যাশা করা। এটা মসজিদের সাথে সম্পর্কের শুধু গুরুত্বপূর্ণ দিকই নয়, ঈমানের অংশ। পক্ষান্তরে মসজিদের কোনোরূপ অকল্যাণ কামনা এর প্রতি চরম বেআদবি ও কুফরের পরিচায়ক।
তামীম দারী রা. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, দ্বীন হল কল্যাণকামিতা। বর্ণনাকারী বলেন, আমরা জিজ্ঞাসা করলাম, কার কল্যাণকামিতা? উত্তরে তিনি বললেন, আল্লাহর, তাঁর কিতাবের, তাঁর রাসূলের, মুসলমানদের ইমামদের এবং সকল মুসলমানের। সহীহ মুসলিম, হাদীস ৯৫
এখানে যেসব ক্ষেত্রে খুলূস ও কল্যাণকামিতাকে দ্বীন বলা হয়েছে তার মধ্যে সবার আগে রয়েছে আল্লাহ তাআলার প্রতি খুলূস ও কল্যাণকামিতা। আর এতে তাঁর প্রতি ঈমান আনা, তাঁর সঙ্গে কোনো কিছু শরীক না করা যেমন রয়েছে তেমনি মসজিদের কল্যাণকামনাও। কেননা মসজিদ তাঁর সবচেয়ে প্রিয় জায়গা।
(গ) মসজিদের সাথে অন্তরের সম্পর্ক
কর্ম অবলম্বন শুধু মানবিক প্রয়োজনই নয়, হালাল পন্থায় হালাল কর্ম অবলম্বন ইসলামের এক ফরয বিধান। এই কর্মব্যস্ততার মধ্যেও যদি মসজিদের সাথে অন্তরের সম্পৃক্ততা থাকে, তবে তা অত্যন্ত মর্যাদার বিষয়। হাদীসে এসেছে, সাত শ্রেণির মানুষকে আল্লাহ তাঁর (আরশের) ছায়াতলে আশ্রয় দিবেন, যেদিন তাঁর (আরশের) ছায়া ছাড়া আর কোনো ছায়া থাকবে না। ন্যায়পরায়ণ ইমাম (বাদশাহ)। ঐ যুবক, যে তার প্রতিপালকের ইবাদতে লালিত-পালিত হয়। ঐ ব্যক্তি, যার অন্তর মসজিদের সাথে সম্পৃক্ত থাকে (এখান থেকে বেরুবার পর থেকে আবার ফেরা পর্যন্ত)...। সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৬০; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১০৩১
মসজিদের সাথে অন্তর সম্পৃক্ত থাকার অর্থ, সে নামাযের সময়ের ব্যাপারে সতর্ক থাকে। সময়মত মসজিদে গমন করে। নামাযের পর যখন মসজিদ থেকে বের হয় পরবর্তী নামাযের প্রতীক্ষায় থাকে। ফলে পাঁচ ওয়াক্ত নামাযই সে স্বচ্ছন্দে মসজিদে গিয়ে জামাতের সাথে আদায় করতে সক্ষম হয়।
দুই. আমলগত সম্পর্ক
আমলগত সম্পর্কেরও বহু দিক আছে। যথা
(ক) মসজিদে গিয়ে জামাতের সাথে নামায আদায়
নামায শুধু একটি ফরয বিধানই নয়, ঈমানের নিদর্শন এবং ইসলামের শিআর। এজন্য প্রয়োজন ছিল তা প্রকাশ্যে সম্মিলিতভাবে আদায়ের ব্যবস্থা। এ জামাতের নামায বিধিবদ্ধ হওয়ার অন্যতম তাৎপর্য। আর এর জন্য জায়গা নির্বাচিত হয় মসজিদ। প্রত্যেক সুস্থ-সবল বালেগ পুরুষের কর্তব্য পাঁচ ওয়াক্ত নামায মসজিদে গিয়ে জামাতের সাথে আদায় করা।
জামাতের ফযীলত ও উপকারিতা অনেক। এতে দৈনিক অন্তত পাঁচবার নিজের ঈমান-আমলের হিসাব নেওয়ার সুযোগ হয়। নিয়মিত নামায পড়ার সৌভাগ্য হয় এবং পারস্পরিক ঐক্য-সম্প্রীতি রক্ষার প্রেরণা জাগে ইত্যাদি।
হাদীসে এসেছে, একা নামাযের চেয়ে জামাতের নামাযের মর্যাদা সাতাশ গুণ বেশি। সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৪৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৬৫০
অন্য এক হাদীসে এসেছে, যে সবচেয়ে দূর থেকে (মসজিদে) আসে তার নামাযের সওয়াব সবচেয়ে বেশি। তারপর যে তার চেয়ে কম দূর থেকে আসে। আর যে ইমামের সাথে নামায আদায়ের জন্য অপেক্ষা করে, সে ঐ ব্যক্তি অপেক্ষা বেশি সওয়াব লাভ করবে যে নামায পড়ে ঘুমিয়ে যায়। সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৪৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৬৬২
এ থেকে বোঝা যায়, মসজিদ দূরে হলেও সেখানে গিয়েই নামায আদায় করতে হবে এবং দূরত্ব অনুযায়ী সওয়াবের পরিমাণও বেশি হবে।
অপর এক হাদীসে আছে, ব্যক্তির জামাতের নামায ঘরে বা বাজারের নামাযের চেয়ে পঁচিশগুণ বেশি মর্যাদা রাখে। আর তা এ কারণে যে, সে যখন উত্তমরূপে অযু করে ঘর থেকে শুধু নামাযের উদ্দেশ্যেই বের হয়, তার প্রতি কদমে একটি মর্যাদা বৃদ্ধি আর একটি গুনাহ মাফ করা হয়। এরপর যখন সে নামায পড়ে তখন ফিরিশতারা তার জন্য দুআ করতে থাকে; যতক্ষণ সে নামাযের স্থানে থাকে। তারা বলে, ইয়া আল্লাহ! তুমি তাকে মাফ করো, তার প্রতি রহমত নাযিল করো। সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৪৭; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৬৪৭
পক্ষান্তরে জামাতের ব্যাপারে কোনোরূপ অবহেলা অতি নিন্দনীয়। হাদীসে এ বিষয়ে কঠোরভাবে সতর্ক করা হয়েছে। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ঐ সত্তার কসম যার হাতে আমার জান! আমার ইচ্ছে হয়, আমি লাকড়ি জমা করার নির্দেশ দেই। তারপর আযানের হুকুম করি। এরপর কাউকে ইমামতির আদেশ দেই। আর আমি ঐ সব লোকের কাছে যাই, যারা নামাযে আসে না। অতঃপর তাদেরসহ তাদের ঘর জ্বালিয়ে দেই। সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৪৪; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৬৫১
এ থেকে যে কেউ উপলব্ধি করতে পারবেন যে, জামাতের ব্যাপারে অবহেলা করা কত ভয়াবহ! নবী-যুগে এটাকে মুনাফিকের আলামত মনে করা হত। কারণ মুনাফিক বা অসুস্থ ব্যক্তি ছাড়া আর কেউ জামাতের নামায পরিত্যাগ করত না। বরং কোনো কোনো অসুস্থ ব্যক্তিও অন্যের কাঁধে ভর করে জামাতে অংশগ্রহণ করত। (দ্রষ্টব্য : সহীহ মুসলিম, হাদীস ৬৫৪)
(খ) তালীমের মজলিশে উপস্থিতি
মসজিদ শুধু নামায আদায় নয়, কুরআন-হাদীস, মাসআলা-মাসাইল ও ইসলমী শিক্ষা-নির্দেশনা শেখা- শেখানোরও জায়গা। নবী যুগ থেকে সাহাবা, তাবেয়ীন, তাবে-তাবেয়ীন ও পরবর্তী অনেক সময় পর্যন্ত এ কাজগুলো প্রধানত মসজিদেই সম্পন্ন হত। পরবর্তীতে এসবের জন্য স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান হলেও মসজিদে তা একেবারে বন্ধ হয়ে যায়নি এবং তা সমীচীনও নয়। কারণ মসজিদে উপস্থিতি এক স্বতন্ত্র আমল (দৈনিক অন্তত পাঁচবার)। তাই এর আগে বা পরে কিছু তালীম হওয়া শুধু সহজই নয়, বরকতময়ও বটে। হাদীসে এসেছে, যখন কিছু লোক আল্লাহর কোনো ঘরে একত্রিত হয়ে তাঁর কিতাব তিলাওয়াত করে, এর ইলম অর্জন করে এবং তা পরস্পর আলোচনা করে তখন তাদের উপর ‘সাকীনা’ নাযিল হয়, রহমত তাদের আচ্ছন্ন করে ফেলে, ফিরিশতারা তাদের বেষ্টন করে ফেলে এবং আল্লাহ তাঁর কাছে যারা থাকেন তাদের সাথে তাদের আলোচনা করেন। সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৬৯৯; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৯২৭৪
সুতরাং সকলের কর্তব্য মসজিদে তালীমের ব্যবস্থা করা এবং তাতে নিয়মিত উপস্থিতির চেষ্টা করা। আর এই তালীমে ব্যাপকতা কাম্য তালীমে দ্বীন, তালীমে কুরআন, দরসে কুরআন, তালীমে সুন্নাহ, তালীমে হাদীস, তালীমে ফাযাইল, তালীমে মাসাইল ইত্যাদি।
(গ) মানুষকে মসজিদের দিকে আহ্বান
নামাযের জামাত ও তালীমের মজলিশে অধিক পরিমাণে মানুষের উপস্থিতি, পুরো এলাকায় হেদায়েতের আলো বিস্তার মসজিদ আবাদের অংশ। এক্ষেত্রে
আয়াত দু’টি সামনে রাখা যায় :
১. (তরজমা) ..আল্লাহর মসজিদ তো আবাদ করে তারাই, যারা আল্লাহ ও পরকালে ঈমান এনেছে, নামায কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় করে না। এরূপ লোকদের সম্পর্কেই আশা আছে যে, তারা হেদায়েতপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে। সূরা তাওবা (৯) : ১৮
২. সূরা নূরের ৩৬ নং আয়াত, যা শুরুতে উল্লেখ করা হয়েছে অর্থাৎ ‘সেইসব গৃহে, যাকে মর্যাদা দিতে ও যাতে তাঁর নাম স্মরণ করতে আল্লাহ আদেশ করেছেন। তাতে সকাল ও সন্ধ্যায় তাঁর তাসবীহ করে সেইসব লোক...’।
এ থেকে বোঝা যায়, প্রকৃত মসজিদ আবাদ কেবল বাহ্যিক কারুকার্যে নয়; বরং ক্রমাগত মুসল্লীর সংখ্যা-বৃদ্ধি, তাদের মধ্যে তাকওয়া ও খোদাভীতি সঞ্চার এবং সর্বত্র হেদায়েতের আলো ছড়িয়ে পড়া ইত্যাদিতে। এ কারণে বাহ্যিক সৌন্দর্যের প্রাচুর্য সত্ত্বেও তা যদি মুসল্লীশূন্য হয়, তবে সেটা বিরান হিসেবেই গণ্য হয়।
মুফতী শফী রাহ. সূরা বাকারার ১১৪ নং আয়াত (অর্থাৎ যে আল্লাহর মসজিদসমূহে তাঁর নাম নিতে বাধা দেয় এবং একে বিরান করার চেষ্টা করে...)-এর অধীনে লিখেছেন, ‘(এ থেকে) বোঝা গেল যে, মসজিদ বিরান করার যত পন্থা আছে সবই নিষিদ্ধ। এতে খোলাখুলিভাবে মসজিদ বিধ্বস্ত করা যেমন শামিল তেমনি এমন কোনো উপায়-উপকরণ সৃষ্টি করাও শামিল, যাতে তা বিরান হয়ে যায়। মসজিদের বিরান এই যে, তাতে নামাযের জন্য মানুষজন আসে না বা কম হয়। কেননা মসজিদের প্রকৃত আবাদ প্রাচীর বা কারুকার্য দ্বারা নয়, আল্লাহর যিকিরকারীদের দ্বারা...।’
তাফসীরে মাআরিফুল কুরআন ১/৩০০
সুতরাং মসজিদের নির্মাণ ও উন্নয়নে যেমন চেষ্টা করা কর্তব্য তেমনি মানুষকে মসজিদমুখী করার ব্যাপারেও ঐকান্তিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা জরুরি।
পক্ষান্তরে মানুষকে মসজিদবিমুখ করা কিংবা তাতে আসতে বা যিকির-ইবাদত করতে বাধা দেওয়া খুবই অন্যায় এবং জঘন্য ধৃষ্টতা।
আল্লাহ তাআলা বলেন, (তরজমা) সেই ব্যক্তির চেয়ে বড় জালেম আর কে আছে, যে আল্লাহর মসজিদসমূহে তাঁর নাম নিতে বাধা দেয় এবং একে বিরান করার চেষ্টা করে? অথচ এরূপ লোকদের জন্য তো সংগতই ছিল না যে, ভীত-বিহ্বল না হয়ে তাতে প্রবেশ করে। এরূপ লোকদের জন্য দুনিয়ায় রয়েছে লাঞ্ছনা আর তাদের জন্য আখিরাতে রয়েছে মহা শাস্তি। সূরা বাকারা (২) : ১১৪
মসজিদে যিকির বা নামায থেকে বাধা দেওয়ার যেকোনো পন্থাই না-জায়েয। তার মধ্যে একটি পন্থা হচ্ছে মসজিদে যেতে বা তাতে যিকির-ইবাদত করতে স্পষ্ট ভাষায় নিষেধ করা। আরেকটি পন্থা হচ্ছে মসজিদে হট্টগোল বা আশেপাশে গান-বাজনা করে মানুষের নামায বা যিকিরে বিঘœ সৃষ্টি করা। এমনিভাবে নামাযের সময় যখন মুসল্লীরা নফল নামায বা তাসবীহ কিংবা তিলাওয়াত ইত্যাদিতে মশগুল থাকে তখন মসজিদে উচ্চস্বরে তিলাওয়াত বা যিকির করা, যাতে তাদের নামাযে বিঙ্গ সৃষ্টি হয় এটাও এক বাধা প্রদান। তবে মসজিদে যখন মুসল্লী না থাকে তখন উচ্চস্বরে যিকির বা তিলাওয়াত করতে কোনো অসুবিধা নেই। দেখুন : তাফসীরে মাআরিফুল কুরআন ১/২৯৯
(ঘ) মসজিদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় অংশগ্রহণ
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ইসলামের এক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। মসজিদের ক্ষেত্রে তা আরো জরুরি। মসজিদ ইসলামের অন্যতম শিআর এবং সম্মিলিত ইবাদতের জায়গা।
কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে, (তরজমা) এবং আমি ইবরাহীম ও ইসমাঈলকে গুরুত্ব দিয়ে বলেছি যে, তোমরা উভয়ে আমার ঘরকে সে সকল লোকের জন্য পবিত্র করো, যারা তাওয়াফ করবে, ইতিকাফ করবে এবং রুকূ ও সেজদা করবে। সূরা বাকারা (২) : ১৬৫
এখানে বাহ্যিক নাপাকী ও ময়লা-আবর্জনা এবং বাতেনী নাপাকীÑ যেমন কুফর, শিরক বিদাআত ইত্যাদি সব কিছু থেকে পবিত্র করা উদ্দেশ্য।
আর আয়াতটি কাবা ঘরের ব্যাপারে নাযিল হলেও ‘আমার ঘর’ বাক্যটি এ দিকে ইঙ্গিত করে যে, এ বিধান অন্যান্য মসজিদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কেননা সমস্ত মসজিদই তাঁর ঘর।
দ্রষ্টব্য: তাফসীরে মাআরিফুল কুরআন ১/৩২৩
উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে মহল্লায় মসজিদ বানাতে, তা পরিষ্কার রাখতে ও তাতে সুগন্ধি লাগাতে আদেশ করেছেন। সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৫৬; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ১৬৩৪
অন্য এক হাদীসে এসেছে, আমার উম্মতের ভালো-মন্দ সব আমলই আমার কাছে পেশ করা হয়। তাদের ভালো আমলগুলোর মধ্যে একটি পেয়েছি, কষ্টদায়ক বস্তু রাস্তা থেকে সরানো। আর মন্দ আমলগুলোর মধ্যে একটি পেয়েছি, মসজিদে পড়ে থাকা থুথু পরিষ্কার না করা। সহীহ মুসলিম, হাদীস ৫৫৪
সুতরাং মসজিদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার গুরুত্ব বিবেচনা করে এর জন্য আলাদা খাদেম রাখা উচিত। এক্ষেত্রে সকলের কর্তব্য মসজিদকে আর্থিকভাবে শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ করা। এভাবে সকলেই মসজিদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় অংশগ্রহণ করতে পারেন। আর সরাসরি অংশগ্রহণ তো আরো সৌভাগ্যের বিষয়।
বড় বড় ক্ষেত্র না হয় বাদই, ছোট ছোটও এমন বহু ক্ষেত্র আছে যাতে স্বচ্ছন্দে সরাসরি অংশগ্রহণ করা যায়। যেমন কাগজের টুকরা পড়ে আছে, সেটা নির্দিষ্টি জায়গায় রেখে দেওয়া। কার্পেট বা তার উপরের চাদর এলোমেলো হয়ে আছে, তা ঠিক করে দেওয়া ইত্যাদি। এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, প্রত্যেকের এ ব্যাপারে সতর্ক থাকা যে, আমার দ্বারা যেন মসজিদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ক্ষুণœ না হয়।
(ঙ) ইতিকাফ
মসজিদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের সাথে ইতিকাফের সম্পর্ক সুগভীর। ইতিকাফের মধ্য দিয়ে বান্দা যে একাগ্রচিত্তে তার প্রতিপালকের যিকির-ইবাদতে মশগুল থাকার সৌভাগ্য অর্জন করে সেটার কোনো তুলনা হয় না। তার উপর তা যদি হয় রমযানুল মুবারকে তাহলে তো নূরুন আলা নূর!
যে খায়ের, বরকত ও ফযীলত নিয়ে রমযানুল মুবারাকের আগমন ঘটে, তা অর্জনের ক্ষেত্রে ইতিকাফের ভূমিকা অসাধারণ। রমযানুল মুবারকের এক বড় নিআমত লাইলাতুল কদর। বিভিন্ন হাদীস দ্বারা প্রমাণিত যে, এটি রমযানের শেষ দশকেরই কোনো এক রাত। এজন্য শেষ দশকে সাধ্য মত পুরো রাত ইবাদতে কাটানোর বিশেষ নির্দেশ রয়েছে, যা অধিকতর সহজ হয় ইতিকাফের মাধ্যমেই।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাদানী জীবনে এক বছর ছাড়া২ বাকি সব বছর ইতিকাফ করেছেন এবং উম্মতকেও এর প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছেন।
এজন্য প্রতিটি মসজিদে অন্তত একজনের ইতিকাফ করা অবশ্যকর্তব্য। কেউ না করলে পুরো এলাকাবাসী সুন্নাতে মুআক্কাদা ছাড়ার গুনাহগার হবে।
(চ) আযান
আযান ইসলামের অন্যতম শিআর এবং পূর্ণাঙ্গ ও প্রভাবক এক আহ্বান। এতে ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলো তথা তাওহীদ, রিসালাত ও মসজিদে নামায আদায়ের আহ্বান রয়েছে। এ দিক থেকে মসজিদের সাথে আযানের সম্পর্ক বেশ হৃদ্যতাপূর্ণ। মুমিনের কর্তব্য বিশুদ্ধ আযান শিক্ষা করা এবং সময়-সুযোগ হলে আযান দেওয়া। আর মুয়াযযিন হওয়ার সৌভাগ্য হলে তো কোনো কথাই নেই!
হাদীসে এসেছে, কিয়ামতের দিন মুয়াযযিনদের ঘাড় সকলের চেয়ে উঁচু হবে। সহীহ মুসলিম, হাদীস ৩৮৭
অন্য হাদীসে আছে, মুয়াযযিনের দূর-আওয়ায মানুষ বা জিন কিংবা যেকোনো বস্তু শুনে, কিয়ামতের দিন সে তার জন্য সাক্ষ্য দিবে। সহীহ বুখারী, হাদীস ৬০৯
তিন. অর্থগত সম্পর্ক
প্রতিটি গ্রামে একটি মসজিদ আবশ্যক এবং তা এতটুকু প্রশস্ত ও উন্নত হওয়া উচিত যাতে এলাকাবাসী সকলেই স্বচ্ছন্দে ও প্রয়োজনীয় আরামের সাথে নামাযসহ মসজিদের সাথে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য আমল করতে সক্ষম হয়।
এর প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব সরকারের। দ্বিতীয় পর্যায়ে জনগণের। প্রত্যেকের কর্তব্য নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী মসজিদের নির্মাণ ও উন্নয়নে সহায়তা করা। যাতে যেসব গ্রামে মসজিদ নেই বা থাকলেও তেমন উন্নত নয় সেখানে একটি উন্নত মসজিদ নির্মাণসহ যাবতীয় ব্যয় নির্বাহ সম্ভব হয়। এটি অত্যন্ত সওয়াবের কাজ এবং সদকায়ে জারিয়ার অন্তর্ভুক্ত। হাদীসে এসেছে, যে আল্লাহর (সন্তুষ্টির) জন্য মসজিদ নির্মাণ করে, আল্লাহর তার জন্য জান্নাতে অনুরূপ ঘর তৈরি করবেন। সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৫০
উৎস: মাসিক আল কাউসার
"মসজিদের সাথে সম্পর্ক"
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
সুন্দর স্বাবলম্বী ভাষায় কমেন্ট করার অনুরোধ রইলো.....