নিশ্চয়ই সকল আমাল (এর প্রতিদান) নির্ভর করে নিয়াতের উপর, প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য তাই রয়েছে, যা সে নিয়াত করে। (১:১ বুখারিঃ তাওহীদ পাবলিকেশন)

মসজিদের আদব ও শিষ্টাচার




মুসলমানদের মসজিদ অন্যান্য ধর্মের উপাসনাগৃহর মতো নিছক কোনো উপাসনাগৃহ নয়। ব্যবহারিক ও ঐতিহাসিকভাবে এর রয়েছে কিছু নিজস্বতা, ভিন্নতা ও স্বকিয়তা। ইসলামের ইতিহাসে মসজিদ নানা গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডেও অবদান রেখেছে। মসজিদ হলো মুসলমানদের প্রধান শিক্ষালয়। এখান থেকে আসে অনেক গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা। দেশের বিভিন্ন দুর্যোগ ও সংকটকালীন মুহূর্তেও এখান থেকে ঘোষিত হয় উত্তরণের গুচ্ছ গুচ্ছ পরিকল্পনা ও কর্মসূচি।




 
মসজিদের অবস্থান

প্রতিটি মসজিদই আল্লাহর ঘর। সে কারণে মুসলমানের কাছে মসজিদ অত্যন্ত পবিত্র ও মর্যাদাপূর্ণ স্থান। আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘মসজিদ মূলত আল্লাহর গৃহ। সুতরাং আল্লাহর সঙ্গে তোমরা অন্য কাউকে ডেকো না।’ (সুরা জিন, আয়াত : ১৮) মসজিদ পৃথিবীর সর্বোত্কৃষ্ট জায়গা এবং আল্লাহ তাআলার সবচেয়ে প্রিয় স্থান। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহর কাছে সর্বোত্তম জায়গা মসজিদ, আর সর্ব নিকৃষ্ট জায়গা বাজার।’ (মুসলিম, হাদিস : ১৫৬০)


 
মসজিদের সঙ্গে মুমিনের সম্পর্ক

মসজিদের প্রতি মুমিনের থাকে এক গভীর আকর্ষণ। মুমিনের কল্পনা, চিন্তাচেতনা ও আবেগ থাকে মসজিদের পবিত্র স্মৃতি দ্বারা প্রভাবিত। সে যেখানেই থাকুক না কেন, তার হৃদয় থাকে মসজিদের সঙ্গে অদৃশ্য বন্ধনে আবদ্ধ। তাইতো প্রতিদিন অন্তত পাঁচবার সে ছুটে আসে এখানে। মসজিদের সঙ্গে এ রকম আত্মা ও রুহের সম্পর্ক যাদের, হাশরের ময়দানে তাদের ঠিকানা হবে আল্লাহর আরশের সুশীতল ছায়াতলে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যেদিন আল্লাহর আরশের ছায়া ছাড়া আর কোনো ছায়াই থাকবে না, সেদিন সাত শ্রেণির লোককে তিনি তাঁর আরশের ছায়ায় স্থান দেবেন, যাদের মধ্যে এক শ্রেণি হলো মসজিদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হৃদয়ের অধিকারী ব্যক্তি।’ (বুখারি, হাদিস : ৬২৯)

 

মসজিদে গমনকারীর মর্যাদা

মসজিদে গমনকারীর প্রতিটি পদক্ষেপে নেকি অর্জন ও গুনাহ মার্জনা হতে থাকে। বাড়তে থাকে তার মর্যাদাও। ইরশাদ হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি নিজের ঘর থেকে পবিত্রতা অর্জন করে ফরজ নামাজ আদায় করার উদ্দেশে আল্লাহর ঘরের দিকে যায়, তার একটি পদক্ষেপে একটি গুনাহ ক্ষমা করা হয় ও দ্বিতীয় পদক্ষেপে তার একটি মর্যাদা উন্নীত করা হয়।’ (মুসলিম, হাদিস : ১৫৫৩)

আগেভাগে মসজিদে গিয়ে নামাজের অপেক্ষায় থাকলে কবুল নামাজের সওয়াব হতে থাকে। কারণ নামাজের অপেক্ষায় বসে থাকা যেন নামাজেই নিমগ্ন থাকার শামিল। নামাজের জন্য অপেক্ষমাণ ব্যক্তিদের জন্য ফেরেশতারাও মাগফিরাত কামনা করতে থাকেন। (মুসলিম, হাদিস : ১৫৪০)। মহানবী (সা.) আরো বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি সকাল-সন্ধ্যায় মসজিদে গমন করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতে সকাল-সন্ধ্যায় আপ্যায়নের ব্যবস্থা করবেন।’ (বুখারি, হাদিস : ৬৩১)

 

জামাতে নামাজ আদায়ের গুরুত্ব

মসজিদে নিয়মিত জামাতে নামাজ আদায় করা সব মুসলমানের দায়িত্ব ও কর্তব্য। মসজিদে জামাতে নামাজের গুরুত্বও অনেক। এক ওয়াক্ত নামাজের সওয়াব ২৭ গুণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায়কারী একাকী নামাজ পড়া অপেক্ষা ২৭ গুণ বেশি মর্যাদার অধিকারী।’ (বুখারি, হাদিস : ৬১৯)

মুসলিম পুরুষের জন্য মসজিদে এসে জামাতে নামাজ আদায় করা ঐচ্ছিক নয়, ওয়াজিবও বটে। এ ব্যাপারে রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমার প্রাণ যাঁর হাতে, তাঁর শপথ করে বলছি, আমার ইচ্ছা হয় আমি কাঠ সংগ্রহ করার নির্দেশ দিই আর নামাজের আজান দেওয়ার জন্য হুকুম দিই। তারপর আমি এক ব্যক্তিকে হুকুম করি, যেন সে লোকদের নামাজের ইমামতি করে। আর আমি ওই সব লোকদের দিকে যাই, যারা নামাজের জামাতে হাজির হয়নি এবং তাদের বাড়ি ঘরসমূহ আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিই।’ (বুখারি, হাদিস : ৬১৮)

 

মসজিদের আদব ও শিষ্টাচার

► অজুসহ পাকপবিত্র অবস্থায় মসজিদে প্রবেশ করা সুন্নত। নাপাক অবস্থায় অথবা পেঁয়াজ-রসুনের মতো দুর্গন্ধযুক্ত কোনো খাবার খেয়ে মসজিদে প্রবেশ করা উচিত নয়। বিড়ি-সিগারেট, গুল-জর্দা, তামাক ও মাদকজাতদ্রব্য খেয়ে মসজিদে প্রবেশ করা মাকরুহ।

► মসজিদে ধীর-স্থিরতার সঙ্গে গমন করা উচিত। রাকাত ছুটে যাওয়ার আশঙ্কায় তাড়াহুড়া করে দৌড়িয়ে যাওয়া ঠিক নয়। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তোমরা নামাজে অবশ্যই ধীর-স্থিরতার সঙ্গে আসবে। যতটুকু পাবে, আদায় করবে। আর যতটুকু ছুটে যাবে, পূর্ণ করবে।’ (বুখারি, হাদিস : ৬০৯)

► মসজিদে মোবাইল ফোনের ব্যবহার এখন অসহনীয় ও অমার্জনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিশেষ করে নামাজের সময় মোবাইলের রিংটোনের কারণে ইবাদতের পরিবেশ বিঘ্নিত হয়। অনেক সময় তা চরম বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করে। তাই মসজিদে প্রবেশের আগে মোবাইল ফোন বন্ধ করা উচিত। ভুলবশত যদি মোবাইল খোলা থাকে আর নামাজরত অবস্থায় রিংটোন বেজে উঠে, তাহলে এক হাত ব্যবহার করে বা নিজ নামাজ ছেড়ে দিয়ে হলেও মোবাইল বন্ধ করে দিতে হবে।

► মসজিদে ডান পা দিয়ে প্রবেশ করা ও বাম পা দিয়ে বের হওয়া এবং মসজিদে প্রবেশ ও বের হওয়ার দোয়া পড়া সুন্নত। মসজিদে প্রবেশর দোয়া হলো—‘বিসমিল্লা-হি ওসসালাতু ওসসালাম-মু আলা রাসুলিল্লাহ, আল্লা-হুম্মাফ্তাহলি আবওয়া-বা রহমাতিক’। আর মসজিদ থেকে বের হওয়ার দোয়া হচ্ছে, ‘বিসমিল্লা-হি ওস্সালাতু ওয়াস সালাম-মু আলা রাসুলিল্লাহ, আল্লা-হুম্মা ইন্নি আসআলুকা মিন ফাদ্বলিক, আল্লা-হুম্মা আ’সিমনি মিনাশ শাইত্বানির রাজিম।’

► মসজিদে সর্বদা ইতিকাফের নিয়তে প্রবেশ করে মসজিদের ভাবগাম্ভীর্য বজায় রাখা উচিত।

► মসজিদে অতিরিক্ত শব্দ করে কোনো কাজ করা ঠিক নয়। দরজা-জানালা ব্যবহারের সময়, হাঁটা-চলার সময় অতিরিক্ত শব্দ যাতে না হয়, সে ব্যাপারেও সচেতন থাকতে হবে। হট্টগোল করা বা উচ্চৈঃস্বরে কথা বলা যাবে না। পাশের লোকের অসুবিধা হয় এমন উচ্চৈঃস্বরে কোরআন তেলাওয়াত করাও জায়েজ নেই। রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, ‘নামাজি ব্যক্তি তার প্রভুর সঙ্গে গোপনে কথা বলে। তার খেয়াল রাখা উচিত, সে কি বলছে। তোমরা কোরআন শরিফ তেলাওয়াতের মাধ্যমে একে অন্যের ওপর শব্দ করো না।’ (বায়হাকি, শুআবুল ঈমান, হাদিস : ৪৪৮০) উচ্চৈঃস্বরে কোরআন তেলাওয়াত করার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা থাকলে উচ্চৈঃস্বরে কথা বলা কতটা অমার্জনীয় বলাই বাহুল্য।

► মসজিদে আগেভাগে গিয়ে প্রথম কাতারে নামাজ পড়ার ব্যাপারে রাসুল (সা.) উদ্বুদ্ধ করেছেন। তিনি বলেন, ‘যদি মানুষ জানতে পারত, আজান দেওয়া এবং প্রথম কাতারে নামাজ আদায়ের মাঝে কী ফজিলত রয়েছে, আর লটারি ছাড়া সেটি পাওয়া সম্ভব না হতো, তাহলে অবশ্যই তার জন্য লটারির ব্যবস্থা করত। এবং যদি জানতে পারত মসজিদে আগে আসার মাঝে কী ফজিলত রয়েছে, তাহলে তার জন্য হামাগুড়ি দিয়ে হলেও আগে আসত।’ (বুখারি, হাদিস : ৫৯০)

► ইমাম ও মুয়াজ্জিন ছাড়া কারো জন্য জায়নামাজজাতীয় কিছু দিয়ে কোনো জায়গা নির্দিষ্ট করে রাখা সম্পূর্ণ অন্যায়। মসজিদের সীমানায় প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে সবার উচিত নিজেদের আল্লাহর গোলাম হিসেবে সমর্পণে ব্রতী হওয়া এবং সব ভেদাভেদ, আমিত্ব ও অহমিকা ভুলে একই কাতারে দণ্ডায়মান হওয়া। আর ইমামের দুই দিক থেকে সমান্তরালে কাতার পূরণ করা।

► মসজিদে প্রবেশকারী দুই রাকাত তাহিয়্যাতুল মসজিদ আদায় ছাড়া বসবে না। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের কেউ মসজিদে প্রবেশ করলে দুই রাকাত নামাজ আদায় না করে বসবে না।’ (বুখারি, হাদিস : ১১১০)

► জামাতে নামাজ আদায়ের সময় কাতার সোজা করে দাঁড়ানো ওয়াজিব। কাতারে জায়গা ফাঁকা রাখা হলে সেখানে শয়তান এসে অবস্থান নেয়। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘নামাজের জন্য কাতারবদ্ধ হও, কাঁধের সঙ্গে কাঁধ মেলাও, ফাঁক বন্ধ করো, শয়তানের জন্য জায়গা ফাঁকা রেখো না। আর যে ব্যক্তি কাতার মেলায়, আল্লাহ তাকে নিজের রহমতের সঙ্গে মেলাবেন। আর যে ব্যক্তি কাতারের মাঝে দূরত্ব বজায় রাখে, আল্লাহ তাকে নিজের রহমত থেকেও দূরে রাখবেন।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৬৬৬)

► মুক্তাদির উচিত সর্বদা ইমামের অনুসরণ করা, ইমামের আগে কোনো আমল করা তার জন্য বৈধ নয়। আবার ইমাম থেকে অনেক দেরিতেও করা যাবে না। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি নামাজে ইমামের আগে মাথা ওঠায় তার কী ভয় হয় না যে আল্লাহ তা’আলা তার মাথাকে গাধার মাথা বানিয়ে দেবেন কিংবা তার আকৃতি গাধার আকৃতিতে পরিবর্তন করে দেবেন।’ (ইবনে মাজাহ : ৯৬১)

► মসজিদে হারানো জিনিস খোঁজা বা ঘোষণা দেওয়া নিষিদ্ধ। তেমনি মসজিদের মাইকে কারো মৃত্যু সংবাদ প্রচার করাও শরিয়ত সম্মত নয়।

► মসজিদের জিনিসপত্র নিজস্ব কাজে বা মসজিদ ছাড়া অন্য কোথাও ব্যবহার করা বৈধ নয়।

► মসজিদ সর্বদা ধুয়ে-মুছে পূতপবিত্র রাখা উচিত।

মহান আল্লাহ আমাদের আমল করার তাওফিক দান করুন।

 

লেখক : পশ্চিম আফ্রিকার মালি প্রবাসী আলেম

Related Posts

"মসজিদের আদব ও শিষ্টাচার"

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সুন্দর স্বাবলম্বী ভাষায় কমেন্ট করার অনুরোধ রইলো.....

Iklan Atas Artikel

Middle Ad

Middle 2

Registered ad