ধর্ষক-বখাটে তৈরি হয় পরিবারে লালন করে সমাজ ও ক্ষমতাধররা
আমরা যেসব ছেলেপুলেকে গ্রামেগঞ্জে বখাটে হতে দেখি তারা কারা? খোঁজ নিলে দেখা যাবে এদের একটি অংশ লেখাপড়ায় পিছিয়ে পড়া, ঝরে পড়া বা পারিবারিক অতি আদরে কিংবা অনাদরে উঠতি বয়সেই জীবনের স্বাভাবিক গতি থেকে ছিটকে পড়া। পরিবারে তাদের দেখভাল করার ক্ষেত্রে নানা দুর্বলতা রয়েছে। ফলে অনেক ছেলেপুলেই পড়াশোনার স্বাভাবিক গতিতে চলতে না পেরে স্কুল পালাতে থাকে, পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হতে থাকে, দোকানপাট ইত্যাদিতে আড্ডা দিয়ে সময় কাটাতে থাকে। এই ছেলেরাই উঠতি বয়সে বিচ্ছিন্ন হয়ে খারাপ চিন্তাভাবনার আড্ডায় জড়িয়ে পড়ে।
প্রতিদিন দেশে ধর্ষক ও বখাটেদের উৎপাতের খবর একাধিক গণমাধ্যমে আসে। এগুলোর কোনো কোনোটি এতটাই লোমহর্ষক যে, সেগুলো সম্পর্কে কথা বলতেও রুচিতে বাধে। গণমাধ্যমসমূহে এ নিয়ে প্রচুর আলোচনা, সমালোচনা হয়। প্রতিদিনই যেহেতু প্রায় একই রকমের ঘটনা ঘটেই চলছে তখন মনে হয় এসব ধর্ষক ও বখাটেকে নিয়ে যত কথাই বলা হোক না কেন, কিংবা তাদের কাউকে কাউকে ধরে থানা পুলিশ, জেল ও বিচারে আনা হোক না কেন অন্যরা তা দেখে বা শুনে তাদের অপকর্ম খুব একটা কমিয়ে দিয়েছে, কিংবা ভয় পেয়েছে তেমনটি মনে হয় না। গণমাধ্যমে এসব অপরাধীর শাস্তির দাবিতে নানা মানববন্ধন, প্রতিবাদ ইত্যাদি ঘটলেও অপরাধীরা যেন অপরাধ সংঘটিত করতে মোটেও দ্বিধা করে না, জেলহাজতের ভয় পায় না। এলাকায় তাদের বোধহয় লজ্জা শরমও পেতে হয় না! অনেক সময় এসব অপরাধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারীরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনী তথা রাষ্ট্রকে কঠোর বিচার নিশ্চিত করার দাবি জানান। এই দাবি অবশ্যই অপরাধের বিচারের শাস্তির স্বাভাবিক নিয়ম হিসেবেই হওয়ার কথা। কোথাও কোথাও হয় কোথাও আবার আইনি নানা জটিলতায় বিলম্ব ঘটে আবার সাক্ষীর অভাবে অনেকেই এক সময়ে ছাড়া পেয়ে যায়, কেউ কেউ জামিনে বের হয়ে আসে, জামিন পাওয়ার পর তারা আরো বেশি বেপরোয়া হয়ে অপরাধ সংঘটিত করতে থাকে। তাদের কাছে নির্যাতিত অনেক পরিবার অসহায় হয়ে পড়ে। অনেক সময় অপরাধীরা তাদের অপরাধ এতটাই বাড়িয়ে দেয় যে হত্যার মতন নিষ্ঠুর অপকর্ম ঘটাতে তারা দ্বিধা করে না। অপরাধীদের এমন দৌরাত্ম্য গ্রামে-গঞ্জে অনেকেই প্রত্যক্ষ করে থাকেন। অনেক সময় শুধু ভুক্তভোগী পরিবারই নয়, গ্রামের অন্যান্য মানুষও এসব অপরাধের অপরাধীর আস্ফালনে নীরব ভূমিকা পালন করে। মূলত এসব বখাটে দীর্ঘদিন থেকে অপরাধ সংঘটনের মাধ্যমে নিজেদের বলয় এতটাই তৈরি করে ফেলে যে তাদের হাত থানা পুলিশ পর্যন্ত গোপনে প্রসারিত হতে থাকে।
আমরা যেসব ছেলেপুলেকে গ্রামেগঞ্জে বখাটে হতে দেখি তারা কারা? খোঁজ নিলে দেখা যাবে এদের একটি অংশ লেখাপড়ায় পিছিয়ে পড়া, ঝরে পড়া বা পারিবারিক অতি আদরে কিংবা অনাদরে উঠতি বয়সেই জীবনের স্বাভাবিক গতি থেকে ছিটকে পড়া। পরিবারে তাদের দেখভাল করার ক্ষেত্রে নানা দুর্বলতা রয়েছে। তাদের লেখাপড়া যে ধরনের দায়িত্ব পরিবারগুলোতে নেয়ার কথা ছিল সেটি যথাসময়ে হয়নি। ফলে অনেক ছেলেপুলেই পড়াশোনার স্বাভাবিক গতিতে চলতে না পেরে স্কুল পালাতে থাকে, পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হতে থাকে, দোকানপাট ইত্যাদিতে আড্ডা দিয়ে সময় কাটাতে থাকে, পিতা-মাতারা এদের খুব একটা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে না। এই ছেলেরাই উঠতি বয়সে বিচ্ছিন্ন হয়ে খারাপ চিন্তাভাবনার আড্ডায় জড়িয়ে পড়ে। সেখানেই তাদের কেউ কেউ মাদকাসক্ত, কেউবা গ্রামে খবরদারি করার প্রবণতা দেখাতে থাকে। এক পর্যায়ে এরাই মেয়েদের দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকানো কিংবা জোর জবরদস্তির মাধ্যমে আদায় করার কর্মকাণ্ডে যুক্ত হতে থাকে। এদের এসব উঠতি অপকর্মকে পরিবার থেকে রোধ করার ক্ষেত্রে অনীহা বা অক্ষমতা থাকে। অনেক ক্ষেত্রেই পিতা-মাতারা তাদের পুত্র সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব বেশি উদ্বিগ্ন হতে চান না। ছেলে সন্তানের প্রতি পরিবারে এক ধরনের অন্ধ সোহাগ ও বিশ্বাস লক্ষ করা যায়। এর পরিণতি যে কত ভয়াবহ হতে পারে, কিংবা পিতা-মাতার নিয়ন্ত্রণে বাইরে চলে যেতে পারে সেটি অনেকেই আগে থেকে বুঝতে পারেন না। আবার কোনো কোনো পরিবারে এ ধরনের বখাটেরা যখন অজ্ঞাত উপায়ে অর্থ উপার্জনের সুযোগ করে নেয়, বিনিময়ে পরিবারের উপরে তার প্রভাব আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয় তখন পরিবার পুত্র সন্তানের চারিত্রিক গতি-প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করে না। পুরুষতান্ত্রিকতার এমন মারাত্মক ব্যাধি আমাদের সমাজের অনেক জায়গাতেই সংক্রমিত হয়ে পড়েছে। এরা তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে নিয়ন্ত্রণ করার পরিবর্তে অনিয়ন্ত্রিতভাবে অন্যদের ওপর চাপিয়ে দিতে দ্বিধা করে না। দেশের আইনকানুন তারা খুব একটা তোয়াক্কা করে না, জানেও না, সেটিকে জানার প্রয়োজনও মনে করে না। এ ধরনের একটি বেপরোয়া মনোবৃত্তি পরিবারের বখাটেদের জীবনের শুরু থেকেই বাড়তে থাকে। এরা বয়ঃসন্ধিক্ষণে যখন যৌনাচারের বিষয়গুলোকে নিজেদের মধ্যে লালন করে তখন তারা বুঝতেই চায় না যে একজন শিশুর সঙ্গে যৌনাচার চলে না। কেননা, একজন শিশুর তখন যৌনাঙ্গই প্রাকৃতিকভাবে গঠিত হয় না। একটি শিশু মূত্রনালী ও যৌনাঙ্গের মধ্যে পার্থক্য কী হতে পারে সেটিই তার জানা নেই। সে কারণেই অনেক বখাটে যুবক, এমনকি বিকৃত রুচিসম্পন্ন, বয়স্ক পুরুষ তিন চার বছরের শিশুর ওপর হামলে পড়তে শোনা যায়। এমন ঘটনা বাংলাদেশে অসংখ্য ঘটতে দেখা যায়। এর প্রধান কারণই হচ্ছে যৌনকর্ম সম্পর্কে ব্যাপক অজ্ঞতা রয়েছে, জ্ঞানও চর্চার অভাবের কারণে এ নিয়ে তাদের মধ্যে বিকৃত রুচিও জন্ম নিতে থাকে। সেখান থেকেই শিশুর ওপর নির্যাতনের ঘটনা বখাটেদের মাধ্যমে ঘটে থাকে। আর অন্য যেসব নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে সেখানেও প্রকৃত শিক্ষা সংস্কৃতি ও জীবন বোধের অভাব সমাজের উঠতি তরুণ ও পুরুষদের মধ্যে ঘটার যথেষ্ট বাস্তবতা বিরাজ করছে। সেখানে আমরা যতক্ষণ পর্যন্ত মনোযোগ না দেব, আমাদের সন্তানকে শিক্ষা-দীক্ষা, মানবিক গুণাবলি, বিবেক, নীতি-নৈতিকতা এবং জীবন গঠনের সৃজনশীল কাজের পথের সন্ধান না দিতে পারব ততদিন আমাদের সমাজে এই সব অপরাধীর উত্থান বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা খুব একটা থাকবে না।
প্রতিটি শিশু-কিশোরকে মানসম্মত শিক্ষায় গঠন করা গেলে তারাই শিক্ষার উচ্চতর ধারায় যখন যুক্ত হবে তখন তারা সহজেই বুঝতে পারবে নারী-পুরুষ সমাজেরই অপরিহার্য অংশ। পিতা-মাতা, ভাইবোন আর সহপাঠী, সহকর্মী এবং স্বামী-স্ত্রী নিয়েই মানুষের জীবন বেড়ে উঠে, গড়ে উঠে। যারা জীবন গঠনের এমন সৃষ্টিশীল ধারায় যুক্ত হয় তারা নীতি-নৈতিকতা, আইন-কানুন, পরিবার, ব্যক্তিজীবন, মানবজীবন, সমাজজীবন, কর্মজীবন ইত্যাদি ধারণাগুলোর সঙ্গে পরিচিত হতে থাকে, সেগুলো নিয়ে নিজেরাও চিন্তাভাবনা করতে শিখে। সেই চিন্তাই তাকে শেখায় কখন তার বিয়ে করার বয়স হবে, কখন তার পরিবার হবে, সন্তান নিয়ে জীবন পরিপূর্ণতায় গঠিত হবে। এসব মৌলিক ভাবনাচিন্তা ছাড়া উঠতি বয়সের যে কোনো কিশোর বখাটে কিংবা অপরাধী হয়ে সমাজে বেড়ে ওঠার অবস্থানে থেকে যেতে পারে। সুতরাং আমাদের চিন্তা করতে হবে জীবন গঠনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সব শিশু-কিশোর তরুণ-তরুণীকে কীভাবে যুক্ত করা যায়, কীভাবে তাদের চিন্তাশীল নীতি-নৈতিকতায় গড়ে ওঠা মানুষে পরিণত করা যায়। তাহলেই সমাজ ও রাষ্ট্র এসব লোমহর্ষক ঘটনার সংগঠক বখাটে, ধর্ষক ও অপরাধীদের হাত থেকে মুক্ত হতে পারে।
"ধর্ষক-বখাটে তৈরি হয় পরিবারে লালন করে সমাজ ও ক্ষমতাধররা"
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
সুন্দর স্বাবলম্বী ভাষায় কমেন্ট করার অনুরোধ রইলো.....